( ছবি ঋণ- ইণ্টারনেট থেকে প্রাপ্ত)

ঘুম থেকে উঠে সোমা রান্না ঘরে ঢোকার মুখে ক্যালেন্ডারে চোখ পড়ল। আজ ১৮ই মার্চ।  আজ দোল, কাল হোলি। অবশ্য এখন হিন্দীর আধিপত্যে সবাই হোলি- হোলি করে। দোল ব্যাপারটা ভুলেই গেছে। সোমার মনে পড়ে যায়, তাদের সময়কার দোলের কথা। ন্যাড়াপোড়া হত, দোলের আগের দিন। পাড়ার এ বাড়ি, ও বাড়ি থেকে শুকিয়ে যাওয়া নারকেল গাছে পাতা জোগাড় করে আনা হত। লুকিয়ে রাখা হত, তারপর দোলের আগের দিন চারটে বাঁশ দিয়ে ত্রিভূজ বানিয়ে নারকেল পাতা দিয়ে ঢেকে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হত। পাড়ার জ্যেঠিমা, কাকিমা সবাই আসত সেই ন্যাড়াপোড়া দেখতে। সোমার এখনো মনে আছে, সেই ছড়ার কলিগুলো, যেগুলো সে আউড়াতো,

    ‘ আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া,

                     কাল আমাদের দোল,

  পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে-

                         বল হরিবোল’!!

খুব মজা হত সেই সময়। বাড়ি বাড়ি ঘুরে দোল খেলা হত। এখন অবশ্য সে সব অতীত। ন্যাড়াপোড়া ব্যাপারটা প্রায় উঠে গেছে। কোলকাতার চারিদিকে বড় বড় গগনচুম্বী ফ্ল্যাট বাড়ি, গাছপালার দেখা মেলা ভার।  তাই এখন দোল ও হোলি আবার হোলিও হোলি। তবে হোলির সময় আগের থেকে একদিন ছুটি বেশি মেলে এই যা তফাত। তবে সোমার বিয়ে হওয়ার পর থেকে সপ্তাহের সাত দিন, বছরের বারো মাস হেঁসেলেই কাটে। তার আর ছুটি বলে কিছু নেই। আগে শ্বশুর- শাশুড়ি যখন ছিল, তখন একটা অন্য মজা ছিল। গল্প করে, সঙ্গ দিয়ে দিন গুজরান হত। হোলির দিনে শ্বশুর শাশুড়ির পায়ে আবীর ছুঁইয়ে একটু গালে আবীর মাখামাখি হত। কিন্তু এখন সেও অতীত। গত দুই বছর হল শশুর শাশুড়ি দুই জনেই গত। মাত্র ছ মাসের ব্যবধানে তাঁরা চলে গেছেন। কোভিড নীরবে এসে কতজনের প্রাণ কেড়ে নিয়ে গেছে, কতজনের সংসার উজাড় করে দিয়ে গেছে তা বলা বাহুল্য। তাই বেদনার স্মৃতি ভুলতে সোমারা এখন শরিকি বাড়ি ছেড়ে ফ্ল্যাটবাসী।

ফ্ল্যাটটা 2bhk এর ফ্ল্যাট। ১২০০ স্কোয়ারফিটের। গায়ে গায়ে লাগানো ফ্ল্যাটগুলোর থেকে এর বিশেষত্ব এই যে এর তিন দিক খোলা, সামনেই আছে পুকুর আর অন্য দুই দিক জুড়ে গভার্নমেণ্টের পাওয়ার হাউস। ফলে ফ্ল্যাট টা একদিক থেকে খোলামেলা আর আলোয় আলোময়। সোমা আড় চোখে দেখে সমীরণকে। ঘুমে কাদা। পাশবালিশ জড়িয়ে ওদিক ঘুরে শুল।  সমীরণের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল দেখশুনা করেই বছর পাঁচেক আগে। সমীরণ একটা কোম্পানির অ্যাাকাউট্যাণ্ট। বেসরকারি কোম্পানিতে নামে ১০টা- ৫ টা অফিস হলেও ছুটি মেলে সন্ধ্যা ৭টায়। আসতে আসতে রাত ৯টা। তাই অন্যদিন সকাল সকাল উঠে রান্না করে গুছিয়ে রাখার তাড়া থাকলেও আজ অবশ্য সেই তাড়া নেই। মনে মনে হাসে সোমা। দোলের দিন ছুটি বলতে এইটুকুই।

প্রত্যেক মানুষের জীবনে দুঃখগুলো অন্যরকম। স্বামী হিসাবে সমীরণের দায়িত্ব -কর্তব্য বা ভালবাসা নিয়ে সোমার কোন ক্ষোভ নেই। দুঃখ তার একটা জায়গাতেই, সমীরণ তার যৌন খিদে মেটাতে অক্ষম। তাদের মধ্যে স্বাভাবিক যৌনতা নেই।  তাই বাচ্চা হওয়ার প্রশ্নই নেই। অথচ আড়ালে লোকের কাছে বাঁজা শব্দটা তাকেই শুনতে হয়।  অবশ্য যৌনতার প্রশ্নে সমীরণ অনেক সাবলীল। তাকে বলেছিল, তার বন্ধু রঞ্জনের সাথে তার সামনে মিলিত হতে। কিন্তু তাতে রাজী হয় নি সোমা। একটা দ্বিধা- ভয় কাজ করেছিল। শ্বশুর- শাশুড়ি বেঁচে থাকতে এই ব্যভিচারে তার মন সায় দেয় নি। আসলে তার বেড়ে ওঠা একটা ভদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারে। সেখানে  প্রতিটা কাজের ভিত্তিতে পাপ-পূণ্যের হিসাব নিকেশ করতে করতে এমন একটা সংস্কারবোধ জন্মে গেছে যে তার থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। তাই সে এখন মানসিক ভাবে একা। অন্যদিন সমীরণ অফিস চলে যাওয়ার পর সে একাই থাকে। ফ্ল্যাট কালচারের সাথে তার মানিয়ে নেওয়া সেভাবে হয়ে ওঠে নি। একে তো নতুন, তাই অন্য পরিবারের সাথে সেভাবে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে নি।

  - ‘ আজ ছুটির দিনে একটু চিলি চিকেন পাকোড়া কর, BP দিয়ে জমবে ভাল’- সমীরণের গলার আওয়াজে সোমার ভাবনাতে ছেদ পড়ল।

  - ‘তার জন্য মাংস আনতে হবে, সাথে আদা -পেঁয়াজ- রসুন। কিন্তু আজ দোলের দিনে বেরোলেই তো রঙ মাখাবে তোমায়’। রান্না করতে করতে আড়চোখে ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে  সোমা বলল।

মুচকি হেসে সমীরণ বলে উঠল, ‘দোলের দিন না হয় একটু মাখলাম। তবে ম্যনেজ করে নেব। মাংস আর সব্জীর ব্যাগ দেখালে অত রঙ দেবে না। আমি বাজার করে রঞ্জনকে নিয়ে আসছি’। মুখ হাত-পা ধুয়ে বাজারের থলি নিয়ে বাইকে বেরিয়ে গেল সমীরণ।

রঞ্জন সমীরণের ভালো বন্ধু, কলেজ লাইফ থেকে তারা একসাথে আছে। সুখে -দুঃখে রঞ্জনকে সবসময় পাশে পাওয়া যায়। রঞ্জনের শরীরটা বেশ পেটানো, জিমে যায়। দেখতে বেশ সুন্দর-টিকালো নাক, লম্বা মুখ, কোঁকড়ানো চুল আর লম্বায় ৫’’-৬’। দারুণ হ্যাণ্ডসাম । সবথেকে বড় কথা যেটা তা হল, রঞ্জন যেমন বিশ্বাসী তেমনি বন্ধু হিসাবে সবার সাথে খুব সহজে মিশে যেতে পারে। তাই রঞ্জনকে নিয়ে যখন সমীরণ আড্ডা মারে, সেও যখন মাঝে মধ্যে আড্ডাতে যোগ দেয়, তখন কোন অস্বস্তি বোধ হয় না। এই যে আজ যে ছোটখাটো পার্টি হবে, তাতে রঞ্জন এর সাথে সোমাও পানীয় মুখে দেবে। রঞ্জন ফাজলামো করবে, ফিচেল হাসি দেবে -কিন্তু কখনোই তার দিকে কুদৃষ্টি দেবে না। এটাই তার কাছে স্বস্তি – তৃপ্তি দেয়।  কিন্তু আজকের দিনটা সোমার কাছে অন্যরকম ভাবনার উদয় হচ্ছে। ভাল লাগছে না, এরকম নিরামিষ ভাবনা।

আজ সোমার হঠাৎ আবীর মেখে সঙ সাজতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছা করছে মনের দুঃখ-কষ্টগুলো আবীর মেখে ধুয়ে ফেলতে। আচ্ছা, সমীরণ আর রঞ্জন আসলে যদি একসাথে দুজনকে সঙ সাজানো যায়! কেমন হবে? দুইজনই বেবাক অবাক হবে নিশ্চয়ই। যে মেয়ে রঙ মাখতে খুব একটা পছন্দ করে না, সে যদি নিজে থেকেই স্বামীকে রঙ মাখায় – একটা চমৎকার ব্যাপার হবে। এটা ভেবেই সোমার মন আনন্দে নেচে উঠল। ভেতরে ভেতরে খুশির জোয়ার এল। পরক্ষণেই আরেকটা ভাবনা মাথায় এল, আবীর পাবে কোথায়? অনেক ভেবে তার মাথায় এল, দেওয়ালে টাঙানো ঠাকুরের আসনের মাথায় গত বছরের আবীর অক্ষত অবস্থায় পড়ে আছে। সোমা, রান্না  ফেলে দৌড়ে গেল আবীর দেখতে। রূপোর থালায় বেশ খানিকটা আবীর ঢেলে নিল সে।

কিন্তু, সমীরণ আসতে দেরি করছে কেন? রঞ্জনকে ধরে আনতে গিয়ে সে আবার মদের ঠেকে বসে পড়ল না তো! তা কি করে সম্ভব? সমীরণ তো বলে গেল মাংস আনতে যাচ্ছে চিলি চিকেন পকোড়া খাবে বলে - সোমার মনের ভাবনার অন্ত নেই ! একটা ছেড়ে গেলে অন্যটা এসে জোড়ে। এইভাবেই তার একাকীত্ব সময়টা কেটে যায়, চিন্তার স্রোতে ভেসে। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল।

ওই এসেছে! সোমা রূপোর থালা  হাতে দৌড়ে গেল দরজা খুলতে। ‘হোলি হ্যায়’- একমুঠো আবীর নিয়ে দরজা খুলেই না দেখেই মাখিয়ে দিল বেল বাজানো ব্যাক্তিটিকে।  তারপর নিজেই খানিক হেসে দরজা খুলে বেশ তাজ্জব হয়ে গেল। একি! যাকে সে রঙ মাখালো সে তো সমীরণ নয়! আর সাথে একা রঞ্জনও তো নেই! বদলে চারটে ছেলে একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্যই ভূত হয়ে। যে ছেলের মুখে মাখালো সেও বেশ থমকে গেছে। রঙ মাখাতে এসে আচমকা রঙ মেখে বসলে একটু অপ্রস্তুত লাগেই। ভুল ভাঙল সোমার। এরা ফ্ল্যাটেরই ছেলের দল। রঙ মেখে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে এসে আহ্বান করে যায় রঙ খেলার জন্য। গত বছর সোমাই দরজা খুলেছিল। সবিনয়ে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু এবার! সোমা অপ্রস্তুত। ঘরে থাকলে সে সাধারণত ম্যাক্সি পড়েই থাকে। ব্রা -প্যান্টি র ধার ধারে না। উত্তেজনায় তার বুকের বোঁটাগুলো শক্ত হয়ে উঠতে লাগল। স্পষ্ট ফুটে উঠল তা নাইটির ভেতর থেকে।

   -‘ও তোমরা! আচ্ছা চল বাইরে যাচ্ছি। আমি কিন্তু জল রঙ পছন্দ করি না’।

   - ‘না, না, বৌদি, আমরাও আবীর নিয়েই এসেছি’।

এরপর আবীর খেলায় মেতে উঠল সোমা। জীবনে এই প্রথম সাবলীল ভাবে। শরীরের প্রতিটি কোণায় কোণায়, খাঁজে খাঁজে নানা রঙের আবীর রঙে প্রলেপ পড়ল। মনের সব আড়ষ্টতা, মলিনতা উধাও হয়ে গেল  এক ফুঁৎকারে। প্রায় ঘন্টাখানিক খেলে সোমা বাড়ি ফিরল। এর কিছুক্ষনের মধ্যেই বেল বাজল আবার। এবার নিশ্চয়ই সমীরণ। দরজা খুলে দিল সোমা। তার রঙ মাখা মুখ- শরীর দেখে সমীরণ অবাক! রঞ্জনের মুখে তখন ফিচেল হাসি। লজ্জা পেয়ে সোমা বলে উঠল, ‘কি করব? ফ্ল্যাটের ছেলেরা এসে জোর করল। এমন নাছোড়, ডাকে সাড়া না দিয়ে পারা গেল না’।

সমীরণ তখন রঞ্জন আর সোমা দুজনের দিকে তাকিয়ে বেশ অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বলল, ‘ আগল তো খুলে গেছে, আজ মদ মাংসে জমে উঠুক তবে’! সোমার চোখ চক্‌চক্‌ করে উঠল, সলজ্জ হাসিতে মুখটা ভরে গেল,ঘুচে গেল সব দ্বিধা।