(ছবি ঋণ - ইন্টারনেট)
মানব সমাজে নগ্নতার ইতিহাস খুব প্রাচীন। সভ্যতা গড়ে ওঠার আগে
মানব সমাজ সকলেই নগ্ন ছিল। ফলে বাহ্যিক নগ্নতা ছিল খুব স্বাভাবিক অবস্থা। পরবর্তীকালে
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে যে সকল মূর্তির নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়, তাতে পোশাকের সাথে
অলঙ্কারের প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ
সাধারণ মনুষ দেহ আবরণের ক্ষেত্রে খুব পোশাক বিলাসী ছিলেন না। ভারতের বুকে বিভিন্ন বহিঃ
আক্রমণ ঘটলেও বহুকাল নারী পুরুষ নির্বিশেষে অর্ধনগ্নতা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। এ প্রসঙ্গে
শ্রী গোপাল পাকড়াশী মহাশয়ের ‘তিন দশকের রিষড়া’ গ্রন্থ থেকে ষোড়শ শতকের (১৬০০- ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দ) সাধারণ মানুষের
বেশভূষার চিত্রটি ফুটে ওঠে।
“ষোড়শ শতাব্দীর রিষড়ার অধিবাসীদের আচার ব্যবহার ও জীবন যাত্রা
প্রণালী যে একই ধরণের ছিল এ কথা সহজেই অনুমেয়।
চালাঘরই ছিল গৃহস্থের সচরাচর বাসস্থান, সাধারণ লোকের পরিধেয় ছিল মোটা ধুতি ও গামছা।
স্ত্রীলোকেরা একখানা শাড়ী কাপড়েই দেহের প্রায় সকল অঙ্গই আচ্ছাদন করতেন”।
-
(তিন দশকের রিষড়া- ১ম খণ্ড -গোপাল পাকড়াশী- পৃষ্ঠা
১৫)
বলাই বাহুল্য, অর্ধনগ্নতা ছিল সেই সময়কার সমাজের বাস্তবচিত্র,
পোশাক বৈচিত্র্য ছিল তখনকার সমাজের বিলাসিতার চিহ্ন স্বরূপ।
এই সামাজিক বিলাসিতার প্রতীক আরো ভালো করে বোঝা যায়, ১৯ শতকে
দক্ষিণ ভারতের চানার বিদ্রোহের দিকে নজর করলে। কেরালার নিম্নবর্ণ ‘নাদার’ সম্প্রদায়ের মহিলারা উচ্চবর্ণ
সম্প্রদায়ের মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য শরীরের ওপরের অংশ ঢাকতে পারতেন না। যদি কেউ ঢাকত,
তবে তাকে ‘স্তন কর’ বা ‘ মূলাকরম’ দিতে হত। জনশ্রুতি এই যে, ‘নাগালী’ নামে এক নিম্নবর্ণের
নারী এর প্রতিবাদে নিজের বুক কেটে ফেলেন এবং মৃত্যুমুখে পতিত হন। এই আবহে চানার বিদ্রোহ
বা ‘মারু মারাক্কাল সংরাম” গড়ে ওঠে।
অর্থাৎ, পোশাককে হাতিয়ার করে মানুষের মধ্যে সামাজিক বৈষম্য
ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে শুরু করেছিল ভারতেও। ক্রমে
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যখন পাকাপাকিভাবে ভারতের শাসক হয়ে ওঠে, ব্রিটিশ সমাজের গণ্যমান্য
হয়ে ওঠার তাগিদে ভারতীয় বুদ্ধিজীবী সমাজ নিজেদের অবস্থাকে দোষারোপ করতে শুরু করলেন
এবং পোশাক পরিচ্ছদে বদল আনার তোড়জোড় শুরু করলেন। সাধারণ মানুষ নগ্নতাকে বিসর্জন দিয়ে
ভদ্রসমাজে পরিণত হলেন। এ প্রসঙ্গে, বামাবোধিনী পত্রিকার ৮ম বর্ষের ৮ ম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে
একটি লেখার অংশ দ্রষ্টব্যঃ-
“এদেশের স্ত্রীলোক যেরূপ পরিচ্ছদ পরিধান করেন, এদেশে চলিত বলিয়া
তাহাতে কেহ দোষ বোধ হয় না। কিন্তু একটু বিবেচনা করিয়া দেখিলে প্রতীত হইবে, ইহা কেবল
উলঙ্গ অবস্থায় না থাকিয়া গায়ে একটি আবরণ দিয়া রাখা মাত্র।…ইহাতে… শীত বাতাদির ক্লেশ
নিবারণ বা ভদ্রতা রক্ষা, পরিচ্ছদ ধারণের যে দুটি প্রধান প্রয়োজন তাহা কোনরূপেই সম্পন্ন
হয় না”।
তাছাড়া, সাধারণ মানুষ নগ্নতার অতি কাছাকাছি থেকেও ভারতের বুকে
তা জনপ্রিয়তা না পাওয়ার অন্যতম কারণ হল বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে জাতিগত বৈষম্য,
হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথা এবং সামাজিক বিধিনিষেধ ও সর্বোপরি নারী পুরুষের মধ্যে
একটা সামাজিক দূরত্ব।
ফলে ভারতের বাইরে আবেগের
বশে নগ্নতা নিয়ে যে আলোড়ন বিপ্লব শুরু হয়েছিল, ভারতে তার কোন প্রভাব লক্ষ্য করা যায়
নি। নুডিসম(Nudism) কথার প্রথম আত্মপ্রকাশ
ঘটে ১৯২৯ সালে যেখানে মানুষ কিছু ক্লাবে আধ্যাত্মিক সুখলাভের উদ্দেশ্যে নিজেদের জন্মপোশাকে
প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে সময় কাটাত। বিদেশীদের কাছে নগ্নতার প্রকাশ যেখানে আনন্দের
বহিপ্রকাশ, প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়ার মূল মন্ত্র, ভারতে তা হয়ে দাঁড়াল সামাজিক ধাপ
উত্তরণের মাপকাঠি। যার নগ্নতার প্রকাশ যত কম,
তার আর্থিক স্বাচ্ছল্য তত বেশি। সামাজিক বৈষম্যের
ফলে প্রকাশ্য নগ্নতা নীচ কাজ বা পাপ অথবা তা শাস্তি স্বরূপ হিসাবে গণ্য হতে লাগল। কোন
গর্হিত কাজের সামাজিক শাস্তি বিধানের ক্ষেত্রে আজও নগ্নতাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার
করা হয়।
আশার কথা এই যে, এত কিছুর মাঝেও নগ্নতা হারিয়ে যায় নি। পোশাক
পরিধানের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। সম্মান- সম্ভ্রমের দোহাই দিয়ে
পুরুষ অপেক্ষা নারীদের পোশাক ছিল বেশি পরিমান ঢাকা। বিংশ শতকের নব্বই দশকে বিনোদন জগতে
যখন নারী পোশাক হাল্কা অনাবৃত করে মানুষের মনে উৎসুকতার জন্ম দিল, মানুষ ধীরে ধীরে
নগ্নতার প্রতি আকৃষ্ট হল। বিজ্ঞান ভিত্তিক যুক্তিবাদী শিক্ষার প্রসার এবং সামাজিক চেতনার
পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মনে নগ্নতার পাপ-পুণ্যবোধ সংক্রান্ত প্রশ্ন জাগতে শুরু
করল। প্রশ্ন করতে শুরু করল অচলায়তন সামাজিক
ধ্যান ধারণার প্রতি। ফল্গু ধারার মত নগ্নতাকে ভালবেসে বরণ করে নিতে শুরু করল ভারতের
কিছু মানুষ। পরে বিশ্বায়নের ফলে বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রম
উন্নতির ফলে চেতনার জগতেও আলোড়ন জেগে উঠতে শুরু করল। সোসাল মিডিয়ার উপর ভর করে সম মনস্ক
মানুষ ধীরে ধীরে সঙ্ঘবদ্ধ হল। এইভাবে বিংশ শতকের শেষ দিকে নগ্নতা সম্পর্কিত আলোচনা,
যা ছিল কল্পনাতীত, নগ্নতার প্রশ্নে আজকের দিনে মানুষ পরষ্পর মিলিত হচ্ছে সমমনস্কতা
নিয়ে।
অবশ্য এ ব্যাপারে ধর্মীয় প্রভাব অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই।
অনেক আগে থেকেই জৈন ধর্মে দিগম্বর সাধুরা, বা নাগা সন্ন্যাসীরা বিনা দ্বিধায় সাধারণ
মানুষের সামনে যে ভাবে নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ান, মানুষের মনে নগ্নতার প্রসঙ্গ কখনোই মুছে
যায় নি। তবে একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, লিঙ্গ বৈষম্যের দরুণ, পুরুষদের কাছে
নগ্নতা যতটা সহজে গ্রহনযোগ্য, নারীদের ক্ষেত্রে তা খুব সহজ নয়। আবার, ভারতের বুকে নগ্নতা ও যৌনতা মিলে মিশে একাকার
হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনে অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিলাতে গিয়ে নগ্নতাকেও
ভোগ্য পণ্যের অধীন হিসাবে মনে করেন অনেকেই।
নগ্নতা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, নগ্নতা আর যৌনতা এক কিনা।
কারণ যৌনতার ক্ষেত্রে নগ্নতা আবশ্যিক। প্রকৃত নগ্নতার অর্থ হল পোশাক ছেড়ে সকলের সামনে
আত্মপ্রকাশ। পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে নগ্নপ্রেমী মানুষ পরিবেশের সৌন্দর্য এবং স্বাভাবিকতাকে উপভোগ করেন।
এই নগ্নতা তিনি ঘরের কোণে বদ্ধ ঘরেও করতে পারেন বা সকলের সাথেও বাইরে নির্জনে করতে
পারেন। তাঁরা ন্যাচারিস্ট (Naturist) নামে পরিচিত। এর মধ্যে যৌনতার কোন সম্পর্ক নেই।
অন্য দিকে যারা নগ্নতা ও যৌনতার মধ্যে কোন তফাত
দেখেন না, তাঁরা নিজেদের নুডিস্ট (Nudist) আখ্যা দেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নগ্নতা নিয়ে সচেতনা প্রসারে, নগ্নতাকে ভালবেসে
কিছু মুহুর্তকে উপভোগ করার জন্য বাংলার মানুষ ও পিছিয়ে নেই। সোনাদা, সন্দীপন দা, দেবু দা – তিন দাদা বাংলায় নগ্নতা
নিয়ে সচেতনতা প্রসারে প্রথম দিশারী। নগ্নতার জগতে সোনাদা একটি অতি পরিচিত নাম। তাঁর নামমাহাত্ম্য সুদূর ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়েছে, তাঁর
ইন্টারভিউ নিতে বিবিসি থেকে সাংবাদিকরা ছুটে
এসেছেন। যদিও, ভারতের বুকে নগ্ন হয়ে প্রকাশ্য সাইকেল র্যালি বা প্রকাশ্য সমাবেশ এখনো
কষ্টকল্পিত স্বপ্ন, কিন্তু নগ্নতা নিয়ে চিন্তাভাবনায় ভারতীয়রা উৎসাহী হয়ে উঠছে। ভারতীয়
সিনেমা জগতের কিছু মানুষ নগ্নতাকে স্বাভাবিক চোখেই দেখেন। এছাড়া, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট ন্যাচারিস্ট
গ্রুপ গড়ে উঠেছে যারা নিজেদের মধ্যে নগ্নতা নিয়ে ভাবনা চিন্তা এবং প্রকাশ্য নগ্ন হন।
আবার এমন অনেকেই আছেন যাঁরা নগ্নতাকে ভালবাসেন, কিন্তু সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে তা প্রকাশ
না করে ঘরের মধ্যেই লুকিয়ে নগ্ন থেকে নিজে আনন্দ উপভোগ করেন।
পরিশেষে বলা যায়, আজকের
এই অশান্ত পরিবেশে, যেখানে হিজাব পরা নিয়ে দেশ উত্তাল, নারীদের উপর যৌন লাঞ্ছনা স্বাভাবিক
ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে নগ্নতার প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করা যায় না। কারণ, নগ্নতা
পরষ্পরকে কাছে টেনে আনে। পারষ্পরিক সম্মান ও বিশ্বাস বোধ, ভ্রাতৃত্ব বোধ, স্নেহ ও মমতার
জন্ম দেয়। নগ্নতা মানুষের মনে আনে শান্তি, সর্বোপরি একটা আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়।
(* আপনি যদি নগ্নতাকে ভালবেসে থাকেন, কিন্তু তা প্রকাশ করতে
অক্ষম হন- এই প্রতিবেদন পড়ে যদি আপনার সুপ্ত বাসনা জেগে ওঠে, তবে আপনি যোগাযোগ করতে
পারেন টেলিগ্রাম আইডি তে-@RajkumarRaychaudhuri)
সূত্র
১) তিন দশকের রিষড়া- ১ম খণ্ড -গোপাল পাকড়াশী- পৃষ্ঠা ১৫
২) উনিশ শতক বাঙালি মেয়ের যৌনতা-অর্ণব সাহা- পৃষ্ঠা
৫২
৩) Encyclopedia of Social Deviance-
Pamela Black, Chapter: Nudism
(pp.471-472)
৫) https://en.wikipedia.org/wiki/Nudity_in_religion
৬) https://en.wikipedia.org/wiki/Breast_tax
৭) https://en.wikipedia.org/wiki/Channar_revolt
0 মন্তব্যসমূহ